█ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফ'র গুলি ও নির্যাতনে ১৫ মাসে নিহত ১৪
█ মাদক-অস্ত্র চোরাচালানী নয় বিএসএফ'র লক্ষ কৃষক-গরু ব্যবসায়ী
█ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সর্বশেষ বলি সানাউল্লাহ
চাঁপাইনবাবগঞ্জনিউজ, ১১ এপ্রিল ২০১১:ভারতীয় সীমান্ত রক্ষি বাহিনী বিএসএফ ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবি’র মধ্যে গেল মার্চ মাসের ১২ তারিখ ভারতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিএসএফ সীমান্তে গুলি না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও গত শনিবার গভীর রাতে পোরশার নীতপুর সীমান্তে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে বাংলাদেশের এক গরু ব্যবসায়ীকে। বিএসএফ-এর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সর্বশেষ বলি গরু ব্যাবসায়ীর নাম সানাউল্লাহ। তার বাড়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রোকনপুর নগরপাড়া গ্রামে। এনিয়ে গত ১৫ মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফ এর হাতে ১৪ বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে আহত হয়েছে অন্তত ৪০ জন। এ নিয়ে গত ১০ বছরে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে নিহত হয়েছে প্রায় ৬০ জন বাংলাদেশী নাগরিক। আহতের সংখ্যা কয়েক শ। এসব হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে বিএসএফ এর করা গুলিতে ও নির্যাতনে। গতবছরে গুলিতে নয়, বিএসএফ এর অমানুষিক নির্যাতনে ৩ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে একজনের হাত পায়ের রগ কেটে দেয়ার ঘটনাও রয়েছে। হত্যাকা-গুলোর পর বিডিআর-এর প্রতিবাদ ও সীমান্ত বৈঠকগুলোয় বিএসএফ গুলি করে হত্যা না করার কথা বললেও বন্ধ হয়নি সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা। সীমান্ত এলাকার মানুষের অভিযোগ, গুলি করে হত্যা করার ক্ষেত্রে মাদক-অস্ত্র চোরাচালানী নয়, বিএসএফ-এর লক্ষ কৃষক ও গরু ব্যবসায়ী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জস্থ ৩৯ বিজিবি ব্যাটালিয়ন সূত্র জানিয়েছে, গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিএসএফ-এর গুলি ও নির্যাতনে সংগঠিত ১৩ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে বেশী হত্যাকাণ্ড ঘটেছে শিবগঞ্জ উপজেলার শিংনগর ও মনোহরপুর বিওপি এলাকায়। বছরের প্রথম হত্যাকা-টি ঘটেছে শিংনগর সীমান্তে। গতবছরের ৯ জানুয়ারি সীমান্তের ১৭২ নম্বর পিলারের কাছে বিএসএফ-এর গুলিতে মারা যায় তারাপুর সাহাপাড়া গ্রামের আব্দুল কাইউমের ছেলে মনিরুল ইসলাম। বিএসএফ-এর দৌলতপুর ক্যাম্পের জোয়ানরা তাকে গুলি করে। একই মাসের ২৮ তারিখ বিএসএফ-এর চাঁদনীচক ক্যাম্পের জোয়ানদের গুলিতে মারা যায় শিবগঞ্জের বিশরশিয়া গ্রামের নরেন কর্মকারের ছেলে শ্যামল কর্মকার (২০)। এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি ফতেপুর সীমান্তে ছত্রাজিতপুর বহালাবাড়ির মুকুল হোসেন (৪০), ২৩ মার্চ কিরনগঞ্জ সীমান্তে বিনোদপুরের একবারপুর গ্রামের তোজাম্মেল হক (৪২), ১২ এপ্রিল ওয়াহেদপুর সীমান্তে সূর্যনারায়নপুরের কালুপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান হাবু (৩৩), ১৪ জুন ফতেপুর সীমান্তে বাবুপুরের শ্যামপুর গ্রামের শফিকুল ইসলাম (৪০), একই মাসের ২১ তাখির চৌকা সীমান্তে আজমতপুরের হাজারবিঘি গ্রামের রবু মিয়া (৪০), ১৬ আগস্ট শিংনগর সীমান্তে মনাকষার পারচৌকা গ্রামের ফটিক (৩০) ও পিয়ালিমারী গ্রামের ইসমাইল হোসেন ইউসুফ (২৫) বিএসএফ-এর গুলিতে মারা যায়। আর নির্যাতনে গত ৪ সেপ্টেম্বর মনোহরপুর সীমান্তে ডাকাতপাড়ার সাইদুর ও গত ১৯ সেপ্টেম্বর একই সীমান্তে ঠুটাপাড়ার ফটিক (১৮) মারা যায়। গত ১৬ অক্টোবর শিংনগর সীমান্তে গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা য়ায় নামোজগন্নাথপুরের আবুল হোসেনের ছেলে আব্দুল লতিফ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে গত বছরের সর্বশেষ হত্যাকান্ডটি হয়েছে গত ৯ ডিসেম্বর মাসুদপুর সীমান্তে। নিহত হয় ঠোটাপাড়ার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে মাহাবুব ওরফে কালু মিয়া (২৫)। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, চলতি বছরে কুড়িগ্রাম সীমান্তে কিশোরী ফেলানীকে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে প্রতিবাদ গণধিক্কার সৃষ্টি হলে কিছু দিন বন্ধ থাকে বিএসএফ-গুলি বর্ষণের ঘটনা। কিন্তু চলতি মাসেই যেন আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বিএসএফ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রোকনপুর ও নওগাঁর নীতপুর সীমান্তের মাঝমাঝি স্থানে শনিবার (৯ এপ্রিল, ২০১১) দিবাগত রাত ৩ টার দিকে ভারতের আগ্রাবাদ বিএসএএফ ক্যাম্পের জোয়ানরা মানবাধিকার লংঘন করে ক’জন গরু ব্যবসায়ীকে লক্ষ করে গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সানাউল্লাহ। আহত হয় একই এলাকার নাজমুল ইসলাম। এদিকে, একই দিন পবা সীমান্তেও বিএসএফ-এর গুলির ঘটনা ঘটেছে। এখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে এক যুবক।
গত ১০ বছরে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তেই প্রায় ৬০ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। ২০০৯ সালে ১০ বাংলাদেশীকে প্রাণ দিতে হয়েছে বিএসএফ-এর গুলিতে। গত ১০ বছরের মধ্যে ২০০২ সালে মাত্র ১ জন মারা গেলেও অন্যান্য বছরগুলোতে বছর প্রতি মারা গেছে ৭ থেকে ৮ জন। এর মধ্যে ৪ বিডিআর সদস্যও রয়েছে। সীমান্তে টহল দেয়ার সময় বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত হয় তারা।
সীমান্তে বছরের পর বছর বিএসএফ-এর গুলিতে সাধারণ মানুষ মরা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিএসএফ-এর অমানুষিক নির্যাতনে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় আত্মংকিত করে তুলেছে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারীদের। বিডিআর ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, গুলি নয়, বিএসএফ-এর নির্যাতন ও হাত পায়ের রগ কেটে পদ্মায় ফেলে দেয়ার ঘটনাতেও মরতে হয়েছে বাংলাদেশী নাগরিকদের। মনোহরপুর সীমান্তে সাইদুরের হাত-পায়ের রগ কেটে নির্মম হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি কিরণগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফ-এর অমানবিক নির্মমতার শিকার হয়ে মরতে হয়েছে তোজাম্মেল হক নামের এক যুবককে। ওই সূত্র জানিয়েছে, তোজাম্মেল হককে ভারতের সুখদেবপুর ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে ক্যাম্পের ভেতরের একটি ঘরের জানালার গ্রীলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখে।
বিজিবি সূত্র বলছে, বছরের পর বছর বিএসএফ- বিনা উস্কানিতে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে সীমান্তে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজিবি কর্মকর্তা জানান, সীমান্তে বিএসএফ যে আচরণ করে তা কোন সভ্যতার মধেই পড়েনা। গুলি বিপরীতের ভাষা হচ্ছে গুলি। কিন্তু বিএসএফ মানবাধিকার চরমভাবে লংঘন করে নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সীমান্ত এলাকার মানুষ জানান, নিহতদের মধ্যে একজনও নেই যারা সীমান্তে অস্ত্র, হেরোইন, ফেন্সিডিলসহ অন্যান্য মাদক চোরাচালন করে। নিহতদের অধিকাংশই গরু ব্যবসায়ী আর কৃষক। তিনি অভিযোগ করেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলা গরু ব্যবসায়ীদের দ্বারা বিএসএফ ‘ম্যানেজ’ হলে কোন কিছুই বলেনা। ‘ম্যানেজে’ গড়মিল হলে তখনই চালায় গুলি।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর, শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট উপজেলার ১২০ কিলোমিটার এলাকাই হচ্ছে ভারত সীমান্ত। এই বিশাল সীমান্ত এলাকার প্রতিটি গ্রামেই বিএসএফ-এর আগ্রাসন ও নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। শিবগঞ্জ, ভোলাহাটসহ সীমান্তের বহু জমিও কৃষকরা বিএসএফ হুমকীর কারণে চাষাবাদ করতে পারেনা। বিজিবি সূত্রগুলো বলছে, ১২০ কিলোমিটার সীমান্ত পথের চোরাচালান প্রতিরোধ, নিরাপত্তার জন্য দুটি ব্যাটলিয়ন কাজ করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে ৮৭ কিলোমিটার এলাকা দেখাশুনা করে ৩৯ বিজিবি ব্যাটালিয়ন আর বাকীটুকু নওগাঁস্থ ৪৩ বিজিবি ব্যাটালিয়ন।
৩৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল আবু বকর আবু পিএসসি জানান, কেউ কোন অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে আইননুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু তারা মানবাধিকার লংঘন করে গুলি ও নির্যাতন করে মানুষ হত্যা করছে। চোরাচালানের ঘটনায় তাদের (ভারতের) এলাকার অনেক বে সামরিক লোকজনও জড়িত থাকে। কিন্ত তারা কেউই বিএসএফ-এর গুলিতে মারা য়ায়না। বিজিবি’র পক্ষ থেকে প্রতিটি ঘটনারই প্রতিবাদ জানানো হয়েছে এবং সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা নানা সমস্যার মাঝেও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
পোষ্ট/অলক/চাঁপাই
0 comments :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন