যুদ্ধাপরাধের বিচার : নির্বাচনমুখী নয়, সর্বজনীন দাবি

মুক্তিযুদ্ধের একটি ব্যাপ্তিকাল থাকে- দিন, মাস বা বছরে তার হিসেব চলে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদর্শের কোনো ক্ষয় হয় না, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা প্রবাহিত হয়ে একটি শাশ্বত রূপ লাভ করে। আজকের বাংলাদেশ তাই আমি মনে করি প্রত্যেক শিশুই জন্ম নেয় মুক্তিযুদ্ধের দুর্বার চেতনা নিয়ে- কেননা প্রতিটি সৃষ্টিই অস্তিত্বের লড়াই-এ জয়লাভের মধ্য দিয়ে অনুভূত হয়।
স্বাধীনতার চার দশক ধরে আমাদের ভুলের ইতিহাস কিন্তু কম নয়। জাতীয় এবং রাজনৈতিক জীবনে আমাদের সবচেয়ে মারাত্মক ভুল হল ‘আপোষনীতি’র কর্তৃত্বে নিজেকে বিসর্জন দেওয়া। এর ফলে ব্যক্তিগত এবং যৌথ লাভ হয়েছে হয়তো অনেকটুকুই- গাড়ি, বাড়ি, উচ্চপদের চাকরি, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন, বিদেশভ্রমণের আভিজাত্য ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মূল্য দিতে হয়েছে অনেক চড়া- বিক্রি করতে হয়েছে বিবেক, আদর্শ ও আত্মা।
একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরে আমরা আমাদের মুক্তির যুদ্ধে জয়লাভ করেছি এটা সত্য। কিন্তু মুক্তির যুদ্ধ কি থেমে গেছে সেদিনই? আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলতে সাধারণত বুঝি সশস্ত্র লড়াই-এর নয়টি মাস। কিন্তু গত চার দশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ যখন বারে বারে খুন হয়েছে- তখন কেন আমরা নিশ্চুপ থেকেছি? কীসের স্বার্থে? কেন আপোষ করেছি? কীসের লোভে? আমার মতে, আমাদের মুক্তির যুদ্ধ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা সমুন্নত রাখার যে লড়াই সে লড়াই আমাদের আজ পর্যন্ত চলছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি আদর্শিক অবস্থান। সভ্যতার ইতিহাসে একটি অনন্য অর্জন হল মানবজাতি যুদ্ধ বিসর্জন না দিতে পারলেও, যুদ্ধের কিছু আইন-কানুন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, আগ্রাসন, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ইত্যাদি তাই বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ বলে স্বীকৃত হয়েছে। এ আলোকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি তাই অত্যন্ত যৌক্তিক বলে আমি মনে করি। একাত্তরে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উৎসাহের অভাব নেই।
এর মূল কারণটি হল এই যে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার নিজস্ব আইনে আন্তর্জাতিক অপরাধরূপে চিহ্নিত অপরাধসমূহের বিচার শুরু করেছে। তবে একই সঙ্গে এটিও স্বীকার করে নিতে হবে যে, এ বিচার নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ষড়যন্ত্রেরও শেষ নেই। আইনের অপর্যাপ্ততা, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডহীনতা, বিদেশি আইনজীবী ও বিচারকের অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের হাতিয়ার ইত্যাদি নানা সমালোচনায় মুখর হয়েছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল। এসব সমালোচনার মূল লক্ষ্যই হল চলমান বিচারিক প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং অগ্রহণযোগ্য করে তোলা।
যুদ্ধাপরাধের বিচার বিশ্বের যেখানেই হয়েছে, পক্ষ-বিপক্ষের লড়াই সেখানেই দেখা গেছে। এ লড়াই শুধুমাত্র আদালত কক্ষেই নয়; বরং সীমানা ছাড়িয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। তাই বাংলাদেশে চলমান বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের তর্ক-বিতর্ক কখনই আমার কাছে অনভিপ্রেত মনে হয়নি। আমি বরং চিন্তিত অন্য একটি বিষয় নিয়ে। আমার মতে, এ মূহুর্তে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হল- রাজনৈতিক ফ্রেম থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বের করে আনা।
যুদ্ধাপরাধের বিচার একটি গোটা জাতির দাবি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের দাবি। এ সত্য উপলদ্ধি আমরা সবাই করি। কিন্ত তারপরও আমাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারটিকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকরণের শিকার হতে হয়েছে। এটা মোটেও কাম্য নয়। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিটি তাই সর্বজনীন, যুক্তিসঙ্গত। রাজনীতিনির্ভর অথবা নির্বাচনমুখী যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি মূলত জাতির সঙ্গে একটি প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়।

তুরিন আফরোজ : ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক।
Flag Counter
পাঠকের সবধরনের মত তুলে ধরতে চাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিউজ । যে কোন বিষয় নিয়ে আপনিও লিখুন আর পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে. সাথে আপনার যোগাযোগের ঠিকানা ,আপনার একটি ছবি পাঠাতে ভুলবেন না।আপনার লেখা বা ছবি আমাদের ইমেল করুন chapainawabganjnews@yahoo.com